চীনের রূপকথা: চাঁদের মেয়ে লিয়ানহুয়া
প্রকাশ: ০১:৪৫, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ০২:১১, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫
সে বহু বহু যুগ আগের কথা।
চীনের দক্ষিণে, বাঁশ-জঙ্গলের পাশে একটি ছোট্ট গ্রামে থাকত লিয়ানহুয়া নামের এক মেয়ে। বয়স মাত্র আট।
তার মা অনেক আগেই মারা গিয়েছিল, আর সৎ মা মাওলিং ছিল ভীষণ কঠোর।
মাওলিং তাকে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করাত—কাপড় ধোওয়া, পানি আনা, কাঠ কাটা, মুরগি দেখাশোনা করা, গোয়াল পরিষ্কারসহ কত কাজ।
কিন্তু খেতে দিত খুব সামান্য, আর কথায় কথায় রাগ ঝাড়ত।
লিয়ানহুয়া কখনো অভিযোগ করত না, শুধু দু’চোখ ভরে কাঁদত।
প্রতিদিন কাজ শেষে লিয়ানহুয়া গোপনে গিয়ে বসত গ্রামের কাছে চিংলান নদীর ধারে।
ক্ষুধার কষ্ট, মায়ের অভাব, সৎ মায়ের বকাঝকার কথা—সবই সে নদীর জলের কাছে বলতো।
নদীটিও যেন তার কষ্টের কথা বোঝে। তাই তো জলের ঢেউগুলো ধীরে ধীরে তার পায়ের কাছে এসে মৃদু শব্দে বলত: কেঁদো না ছোট্ট মেয়ে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
লিয়ানহুয়ার চোখের অশ্রু নদীতে পড়লেই পানি চিকচিক করে উঠত। তার কষ্ট নদীর বুককে ঠান্ডা করে দিত।
একদিন দূর আকাশের চাঁদ ইউয়েগুয়াং, নদীর উপর ছাঁয়া ফেলে লিয়ানহুয়ার কান্না দেখল।
চাঁদ দুঃখ করে বলল: এই শিশুটি এত কষ্ট পাচ্ছে! আমি কী করতে পারি?
সেই সময়ে সূর্য রিহুয়ো উঠছিল দিগন্তে। সে বলল: যদিও আমি আলো দিই। কিন্তু ওকে সুরক্ষা দিতে পারছি না। আমাদের ওর জন্য কিছু করা উচিত।
নদী, চাঁদ আর সূর্য—তিনজন মিলে দীর্ঘ পরামর্শ করল। ওদের সবার মন ভীষণ ব্যথায় ভারী।
এক রাতে, যখন আকাশ ছিল একেবারে নীরব ও পরিষ্কার, লিয়ানহুয়া আবার নদীর ধারে এসে ফিসফিস করে বলল: ওহে নদী, আমি খুবই ক্লান্ত। একটু শান্তি চাই।
চাঁদ এই কথাগুলো শুনে আর থাকতে পারল না। সে নিচে নেমে এলো এক রূপালি সিঁড়ির মতো আলো নিয়ে। চাঁদের আলো লিয়ানহুয়ার গায়ে স্পর্শ করতেই সে ঘুমে তলিয়ে গেলো।
সেই মুহূর্তে চাঁদ তার কোমল হাত বাড়িয়ে লিয়ানহুয়াকে কোলে তুলে নিল।
ঠিক তখনই নদী খুশিতে ঢেউ তুলল, সূর্য দিগন্ত থেকে আলো পাঠাল, আর বাতাসও মৃদু হাসল।
লিয়ানহুয়া জেগে উঠে দেখল—সে আছে চাঁদের রূপালি প্রান্তরে। চারপাশ জুড়ে সাদা আলো আর শান্তি। দিগন্ত জোড়া নরম মেঘের মাঠ।
চাঁদ বলল: এখন থেকে তুমি আমার আদুরে মেয়ে। এখানে তোমাকে কেউ কষ্ট দেবে না।
লিয়ানহুয়া চাঁদের বুকে মাথা রাখল। অনেক বছর পর তার মুখে হাসি ফুটল।
চাঁদ তাকে শেখাল রূপালি সুতা কাটার জাদু। যে সুতা মানুষের দুঃখকে শান্তির আলোতে ভরিয়ে দেয়।
তারপর থেকে প্রতি মাসে যখন পূর্ণিমা আসে, লিয়ানহুয়া চাঁদের কোলের ওপরে বসে রূপালি চাকা ঘোরায় আর আলোর সুতা কাটে। সেই সুতা চাঁদের কিনার দিয়ে পৃথিবীতে ঝরে পড়ে। কখনো বৃষ্টির মতো ঝিকমিক করে। কখনো নদীর ঢেউয়ে সোনালি ছটা হয়ে পড়ে। কখনো আবার মানুষের চোখের দুঃখ মুছে দেয় নিঃশব্দে।
পূর্ণিমার রাতে চাঁদের দিকে ভালো করে তাকালে দেখা যাবে, চাঁদের সাদা আলোয় একটি ছোট্ট মেয়ে একা একা বসে সুতা কাটছে। আর তার সে সুতা থেকে আলো ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীতে শান্তি বিলিয়ে দিচ্ছি।
ওদিকে লিয়ানহুয়া চাঁদে চলে যাওয়ার পর পূর্ণিমার এক রাতে রূপালী আলোর ছটা হঠাৎ সৎ মা মাওলিং-এর চোখে এসে পড়ে। সৎ মা বুঝতে পারে সে কত বড় ভুল করেছে। লোকে বলে, ওটাও নাকি লিয়ানহুয়ার জাদুর সুতার কাজ, যা খারাপ মনকে ভালো করে দেয়।
আজও নাকি সৎ মা মাওলিং নদীর ধারে গিয়ে লিয়ানহুয়ার নাম ধরে কাঁদে। কিন্তু মেয়ে আর ফিরে আসে না। তবে ওর ছড়িয়ে দেয়া আলো পৃথিবীকে কোমল করে তোলে। আলোর ছোঁয়ায় সৎ মায়ের হৃদয়ও নরম হয়ে যায়।
এখনও পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পূর্ণিমার রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে খুঁজে বেড়ায় লিয়ানহুয়ার ছোট্ট ছায়া। আর মায়ের কাছে গল্প শোনে, হাজার হাজার বছর আগে কত ভালোবাসায় আকাশের আলোরা একটি দুখি মেয়েকে রক্ষা করেছিল।
(চীনের রূপকথা)
৪ ডিসেম্বর, ২০২৫
লেখক: শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
