রিয়াদ ফ্যাশন উইক ২০২৫
ঐতিহ্যের ক্যানভাসে ফ্যাশনের নতুন রাজধানী
রাজীব শাঁখারী
প্রকাশ: ২২:০৭, ২৬ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২২:২৮, ২৬ নভেম্বর ২০২৫
সৌদি আরবের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের প্রতীক এই ফ্যাশন উইক। ছবি: রিয়াদ ফ্যাশন উইক-২০২৫ ইন্সটাগ্রাম
সৌদি আরবের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের প্রতীক এই ফ্যাশন উইক। ঐতিহ্য, আধুনিকতা ও আত্মবিশ্বাসের মেলবন্ধনকে নতুন এক ফ্যাশনের ভাষা হিসেবে তুলে ধরেছে এই ছয় দিনের আয়োজন। যেখানে বিশ্বের নতুন ফ্যাশন ক্যাপিটালের স্বীকৃতি আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে সৌদি আরবের রিয়াদ ফ্যাশন উইক।
একসময়ের তেল, মরুভূমি আর বিশাল স্থাপত্যের দেশ সৌদি আরব আজ নিজেকে নতুন আলোয় আবিষ্কার করছে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে সৌদির রিয়াদ এখন বলছে সৃজন, উদ্ভাবন আর সংস্কৃতির নবজাগরণের গল্প। ‘রিয়াদ ফ্যাশন উইক ২০২৫’ সেই গল্পেরই এক গুরুত্বপূর্ণ পটভূমি। ছয় দিনের এই উৎসব ছিল শুধু পোশাক প্রদর্শন নয়, বরং এটি ছিল এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব। যেখানে ঐতিহ্য, আধুনিকতা ও আত্মবিশ্বাস মিলেমিশে তৈরি করেছে সৌদি ফ্যাশনের এক নতুন ভাষা।

ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন
‘দ্য পাম গ্রোভে’তে পর্দা ওঠে রিয়াদ ফ্যাশন উইক-২০২৫ এর। শুরুতেই প্রদর্শীত হয় কিংবদন্তি ডিজাইনার ভিভিয়েন ওয়েস্টউডের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে। তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত এই আয়েজনের শুরু থেকেই স্পষ্ট ছিল পশ্চিমা নান্দনিকতার সঙ্গে আরব ঐতিহ্যের মেলবন্ধনই হবে এবারের আসরের মুল প্রাণ। স্থানীয় সূচিশিল্পীদের হ্যান্ড এব্রয়ডারিতে ফুটে উঠেছিল হাশু, নাকদা ও জরির সূক্ষ্ম কারুকাজ। নিখুঁত ব্রিটিশকাট এবং আরবের সূচিকর্মের মিশেলে তৈরি প্রতিটি পোশাকই যেন একেকটি শিল্পকর্মের ছোঁয়া।
ফ্যাশন উইকের তিনটি ভেন্যু ‘দ্য বেডরক’, ‘দ্য রুফ-আল মামলাকা’ এবং ‘জ্যাক্স বিফাইভ’। এই তিনটি ভেন্যুই তিনটি সময়ের বার্তা বহন করে। প্রথমটি ইতিহাসের স্মারক, দ্বিতীয়টি আধুনিকতার হৃৎস্পন্দন, আর তৃতীয়টি হলো ভবিষ্যতের নিরীক্ষাগার। এই তিন পরিসরের সংযোগই সৌদি ফ্যাশনের আত্মপরিচয়, স্বকীয়তায় দৃঢ় এবং বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত।

সাহস, সৌন্দর্য এবং নারীসত্তার গল্প
সৌদি ডিজাইনার টিমা আবাদিয়া এবং অ্যাটেলিয়ার হেকায়্যাতের ‘আ টিকিট টু দ্য থিয়েটার’ শিরোনামে হেকায়্যাতের উপস্থাপনাকে বলা যায় থিয়েট্রিক্যাল কবিতা। তার উপস্থাপনায় ছিল পোশাকের অনবদ্য উপস্থাপন। আলিয়া ও আবর ওরাইফ, দুই বোন। তাদের ব্র্যান্ড ঐতিহ্যের মমতায় আবৃত সংগ্রহের মাধ্যমে তুলে ধরেছে নারীর আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রেমের কথা। তাদের পোশাকি বার্তায় প্রতীয়মান হয়েছে পোশাকের ভাঁজ, আলো–ছায়া আর সূক্ষ্ম অলংকরণে সৌদি সৃজনশীলতার উন্মেসের ধারা।
অপরদিকে আবাদিয়ার সংগ্রহে প্রকাশ পেয়েছে সাহস, কোমলতা আর উত্তরাধিকারের গল্প। ডিজাইনার শাহদ আল-শেহাইল তার দাদার সমুদ্রযাত্রায় অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করেছেন আত্ম–আবিষ্কারের প্রয়াস। যেখানে নারী শক্তির উপাখ্যানে লিখেছেন মুক্তা আহরণের গল্প। রানওয়ে–মাতানো এসব পোশাকে মূলত প্রকাশিত হয়েছে সৌদি নারীর দৃঢ়তা এবং স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। প্রকাশ পেয়েছে সৌদি নারীর নিজেদের আলো।

ত্রিশ সৌদি ডিজাইনারের ক্যানভাস
গগনচুম্বী ভবনগুলোর মতোই উচ্চাভিলাষী আয়োজন ছিল রিয়াদ ফ্যাশন উইকের পরিধি। ছয় দিনের এই আসরে ত্রিশজন সৌদি ডিজাইনার তাদের কাপড়ে ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন সূচিকর্মের নিপুণতা। ত্রিশ ডিজাইনারদের মধ্যে ছিলেন টিমা আবিদ, আদনান আকবার, লিমা, ফেমিনাইন, আশওয়াক আলমারশাদ, কোরমুজ, হিন্দামে, রাজান আলাজ্জোনি, রিম আলকানহাল, ইলেভ ইলেভেন, দ্য রুফ-আল মালাকা ও এইটিনএইটিসিক্সের মতো বিশ্বমানের ব্র্যান্ড-লেবেল।
হিন্দামনের ডিজাইন করা টি-শার্টে ‘সৌদি অ্যারাবিয়া ইজ দ্য ফিউচার’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছে পুরো প্রজন্মের আত্মবিশ্বাস। অন্যদিকে কোরমুজের ‘বেদুইন’ মোটিফের ব্যাগ তুলে ধরেছে ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। আবার ‘দ্য রুফ-আল মালাকা’র পোশাকে উঠে এসেছে আধুনিকতার নিখুঁত টেইলরিং, মার্জত বর্ণবিন্যাস এবং বিশ্বমানের ফিনিশিং।

বিশ্বখ্যাত ডিজাইনারদের পদচারণায় মুথরিত
ব্রিটিশ পাঙ্ক ডিজাইনার ভিভিয়েন ওয়েস্টউডের সংগ্রহের উপস্থাপনায় পর্দা উঠেছিল এবারের আসরের। প্রয়াত এ ডিজাইনারের অশরীরী উপস্থিতি যেন আসরকে দিয়েছে অন্য মাত্রা। আর, ছয় দিনের ফ্যাশন উৎসবের পর্দা নামে আরেক ব্রিটিশ কিংবদন্তি স্টেলা ম্যাককার্টনির সশরীরী ও প্রোজ্জ্বল উপস্থিতিতে। এবারই প্রথম দুই বিশ্বখ্যাত ডিজাইনারের সংগ্রহ সৌদি আরবের এই অঞ্চলে প্রদর্শিত হলো।
রিয়াদে রূপ ও বাস্তবতার এক মেলবন্ধন ছিল স্টেলার অভিষেক প্রদর্শনীটিতে। মেটালিক স্লিংকি গাউন, অ্যানিমেল প্রিন্ট ট্রেঞ্চ, থাই-হাই বুট ও ত্রিশের দশকের স্লিপ ড্রেস। সব মিলিয়ে আধুনিক নারীর আত্মবিশ্বাস ও শৈল্পিক রুপ দিয়েছে স্টেলার ডিজাইনে। স্টেলার এই প্রদর্শনীতে ছিল একটি বার্তাও। তিনি বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সৌদি ফ্যাশনে এখন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ডিজাইনাররাও এসে তাদের পোশাকি শিল্পকে উপস্থাপন করতে সাচ্ছন্দ বোধ করেন।

বিশ্বমঞ্চে সৌদি আরব
এই আসরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের অংশগ্রহণ। ইতালির ‘আমেন’, দক্ষিণ কোরিয়ার ‘ইহ নম উহ নিট’ এমনকি ‘কোপ্পালা এ টোপ্পো’র মতো ব্র্যান্ডগুলো সৌদি বাজারের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। এরসঙ্গে স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো, যেমন- লিমা, ফেমনাইন বা হিন্দামনে তাদের সৃষ্টিকর্মে দেখিয়েছে জাতীয়তাবোধের সঙ্গে আধুনিকতার মিশেলের অনবদ্য উপস্থাপন। স্ট্রিটওয়্যার লাইনগুলোতেও দেখা গেছে সৌদি তরুণদের আত্মবিশ্বাস ‘সৌদি অ্যারাবিয়া ইজ দি ফিউচার’ লেখা টি-শার্টের বিম্বিত হয়েছে নতুন প্রজন্মের মনোভাব।

ফ্যাশনের নতুন রাজধানী
এই ফ্যাশন উইকের ছয় দিনে রিয়াদ এক চলমান আর্ট গ্যালারিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ওপেন-এয়ার ভেন্যু, ভবিষ্যৎধর্মী সেট ডিজাইন এবং আন্তর্জাতিক অতিথিদের ভিড়। সব মিলিয়ে এটা ছিল আরব বিশ্বের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী আয়োজন। আয়োজনে স্থানীয় ব্র্যান্ডের সঙ্গে অংশ নিয়েছেন ইউরোপ, ইতালি এবং দুবাইয়ের ডিজাইনাররা। ফ্যাশন এডিটর, স্টাইলিস্ট ও রিটেইলাররা স্পষ্ট জানিয়েছেন, সৌদি ডিজাইনারদের কাজ এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম। থাই অভিনেত্রী উইন মেটাউইন, ফায়ে পেরেইরা ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সঙ্গিনী জর্জিনা রদ্রিগেজের উপস্থিতি রিয়াদের ফ্যশন উইককে পরিনত করেছে তারকাখচিত উৎসবে।

সৌদি ফ্যাশন এখন আর্থিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি
সৌদি ফ্যাশন কমিশনের সিইও বুরাক চাকমাক বলেছেন, ‘আমাদের ঐতিহ্যের কোনো সীমা নয়, বরং আমাদের এই যাত্রার এটা সূচনামাত্র। আমাদের ডিজাইনাররা জানেন, কীভাবে ঐতিহ্যকে আধুনিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘সৌদি ডিজাইনাররা তাদের নিজস্ব ভোক্তার রূচি বুঝে কাজ করেন, এবং সেটিই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। এই শিল্প এখন বৈশ্বিক, তবু গভীরভাবে স্থানীয়।’ তার নেতৃত্বে সৌদি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি ইতিমধ্যেই ৪২ বিলিয়ন ডলারের টার্নওভার পেয়েছে, যা দেশের জিডিপিতে ২.৫% অবদান রাখছে।
সৌদি ডিজাইনারদের ভাষ্য
‘ফারফেক্ট’এর প্রথম সৌদি স্টাইলিস্ট নৌফ আলনাম্লাহ বলছিলেন, ‘আমি প্যারিসে কোনো সৌদি ডিজাইনারের পোশাক পরলে সবাই জিজ্ঞেস করে, এটা কোথাকার? তখন গর্বে বুক ভরে যায়।’ ডিজাইনার রিম আলকানহাল অনুপ্রাণিত হয়েছেন সৌদি নারীর পোশাক সংস্কৃতি থেকে। তিনি বলেন, ‘আজকের নারীরা ঐতিহ্য ভালোবাসে, কিন্তু আধুনিকতা থেকেও পিছিয়ে থাকতে চান না। তারা রং ও স্টাইল নিয়ে নিরীক্ষা করতে জানেন। এটা কেবল ফ্যাশন নয়; বরং আত্মবিশ্বাসেরই উদ্যাপন।’

পোশাকে রঙিন ভবিষ্যতের হাতছানি
সৌদি আরবের নতুন সাংস্কৃতিক ভাষা এখন ফ্যাশন। আর তার প্রমাণ, রিয়াদ ফ্যাশন উইক ২০২৫ এর সফল আয়োজন। এই আসরে রানওয়ের গ্ল্যামারের সঙ্গে প্রতীয়মান হয়েছে ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কার, নারীর ক্ষমতায়ন এবং বিশ্বজয়ের আত্মবিশ্বাস।
দ্য পাম গ্রোভের নিচে ঝলমলে আলো–ছায়ায় যেভাবে আরব সূচিকর্মে পশ্চিমা স্টাইল মিশেছে, তেমনি সৌদি ফ্যাশন এখন বিশ্ব ফ্যাশনের ক্যানভাসে যোগ করেছে নতুন রঙ। এই রঙ ঐতিহ্য, প্রত্যয় এবং ভবিষ্যত অগ্রযাত্রার প্রতীক। তাই এই আসর দিয়েছে এক আশাজাগানিয়া বার্তা। আর তাহলো ‘ফ্যাশন, এখন আর কারো অনুকরণ নয়, এটা সৌদি আরবের নিজস্ব সৃজনের উৎযাপন।’
