অপারেশন পর্ব-১
এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরি
প্রকাশ: ০৩:২৪, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫
মো. সিরাজুল ইসলাম খন্দকার, বীর মুক্তিযোদ্ধা। গ্রাফিকস: সমাজকাল
[একাত্তর যখন এলো তখন আমি কিশোর। সেই কিশোর বয়সেই ভারতের অম্পিনগরে (আসাম) গিয়ে গেরিলা যুদ্ধের উন্নত প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ি।
স্বাধীনতার ৫২ বছরে (করোনা পূর্ববর্তী ২ বছর) দুটি হাইস্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা শোনানোর জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। আর কখনো মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ইতিহাস সংকলিত করার প্রচেষ্টা নিইনি। আমার মনে হয়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যারা এখনো বেঁচে আছেন, এখনো সময় আছে, মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ ও অভিযান সংবলিত বাস্তব ঘটনাবলি সংকলিত করার।
গত ঈদুল ফিতরের পরদিন আমার পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার বুড়িচং থানার মকিমপুর ও আশপাশের কিছু এলাকা ভ্রমণ করি। বাড়ি থেকে কুমিল্লায় প্রত্যাবর্তনকালে আমার ওমানপ্রবাসী বড় মেয়ে হঠাৎ করেই, মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলার জন্য আবদার ধরে। ভাবলাম, সে যেহেতু আমার বংশধর এবং উত্তরাধিকার—তাই তাকে দেশ স্বাধীন করার জন্য জনগণের আত্মত্যাগ ও রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের গল্প বা ঘটনাবলি শোনানো খুব দরকার এবং আবশ্যক। যাতে করে, আমার মৃত্যুর পর জাতি না জানলেও ছেলেমেয়েরা একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাবার বাস্তব লড়াইয়ের কথা সবার সাথে শেয়ার করতে পারবে।]
সম্ভবত অক্টোবর মাসের ঘটনা। আমরা যুদ্ধের ময়দানে ২২ জন মুক্তিযোদ্ধার একটা গ্রুপ। নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একজন হাবিলদার। স্থানটি কুমিল্লার কসবা সীমান্তবর্তী মন্দভাগ এলাকা। সেখানে মইনপুর নামক এক গ্রামের মাটির ঘরে আমাদের ক্যাম্প। মজার বিষয় হলো, যুদ্ধের পুরো সময়টা মন্দভাগ মুক্তিযযোদ্ধাদের দখলে, অন্যদিকে শালদা নদী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলে ছিল। একপর্যায়ে মন্দভাগ দখলের জন্য হানাদার বাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে।
অক্টোবরের কত তারিখ মনে নেই। তখনও ভোরের সূর্য উঁকি দেয়নি। হঠাৎ করেই দেখলাম পাকিস্তানি বাহিনী লাইন ধরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তারা হয়তো ভাবেইনি এতটা ফ্রন্ট লাইনে আমাদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) ক্যাম্প আছে। শেষ রাতের ডিউটিতে আমি ও সহযোদ্ধা হান্নান ক্যাম্প পাহারায় ছিলাম। আমরা কমান্ডার ও অন্য সকলকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলি। সবাই ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রেডি হতে থাকে। কমান্ডার আমাদের নির্দেশ দেন, পজিশন অনুযায়ী তিনি এলএমজি (লাইট মেশিন গান) থেকে ফায়ার করার সাথে সাথে সকলেই ফায়ার করা শুরু করবে। প্রথম সারির ১০/১৫ জন থাকবে কমান্ডারের টার্গেট। পরবর্তীদের করণীয়গুলো ভাগ করে দেওয়া হয়। আমি কমান্ডারের ব্যাংকারে এসএলআর (সেলফ লোডিং রাইফেল) হাতে পজিশন নিই।
পাকিস্তানি বাহিনী ৩০০/৪০০ গজের মধ্যে আসার সাথে সাথেই কমান্ডার ফায়ার শুরু করে। একইসাথে আমিও পাকিস্তানি বাহিনীর ৪/৫ জনকে টার্গেট করে ফায়ার শুরু করি। আকস্মিক গুলিবৃষ্টিতে হতচকিত পাকবাহিনীর অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাতরাতে থাকে। এমনকি লাইনের সামনে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডার ও সিগন্যালম্যানও গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে চিৎকার শুরু করে। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। আমরা জীবনমরণ লড়ছি। তারাও অনেকটা গুছিয়ে নিয়ে আমাদের নিশানা করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। দেখলাম, একজন আহত সৈন্যকে কাঁধে নিয়ে ক্রলিং করে পিছিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনীর আরেক সৈন্য। অমনি শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর কামানের গোলাবর্ষণ। আমাদের সামনে ও পেছনে গোলা বিস্ফোরিত হতে থাকে। ভাগ্যিস তাতে কোন মুক্তিযোদ্ধার ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, যুদ্ধ চলতে থাকে।
বেলা ১১টার দিকে আমাদের কমান্ডার আমাকে ও হান্নানকে প্রায় এক কি.মি. দূরের ক্যাম্প থেকে খাবার নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দেন। এমন তীব্র গোলাগুলির মধ্যে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। তাই আমরা ক্রলিং করে করে খাবার আনতে খালের ভেতর দিয়ে যেতে শুরু করি। মাথার উপর দিয়ে শা শা করে গুলি ছুটে যাচ্ছে। চার/পাঁচশ গজ এগুনোর পর দেখি, পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধবিমান মাথার উপর দিয়ে চক্কর দিচ্ছে। আমরা দ্রুত একটি মাটির ঘরে গিয়ে উঠলাম। সেখানে ঘরের মালামাল এলোমেলো। একটা ট্রানজিস্টার ছিল। আমি হান্নানকে এটা নিতে বলায় সে অস্বীকার করে এবং বলে, দেখছ তো ফাইটার বিমান আকাশে চক্কর দিচ্ছে। আমরা এখন যে কেউ মারা যেতে পারি। যাইহোক, ফাইটার বিমান চলে যাওয়ার পরে আমরা ঘর থেকে বের হলাম এবং জানলাম, পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান আক্রমণের মুখে কৌশলগত কারণে মইনপুর থেকে আমাদেরকে উইথড্র করা হয়েছে।
এখানে একটা কথা বলে রাখি, সহযোদ্ধা হান্নান আজ আর বেঁচে নেই। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর, স্বাধীন দেশে সে কোন কাজ বা চাকরি খুঁজে না পেয়ে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং একপর্যায়ে ডাকাতি শুরু করে। একসময় সে কষ্ট নিয়েই পরপারে চলে যায়।
>>> চলবে
