আজ কুড়িগ্রাম মুক্ত দিবস
এম,আযম,কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১১:০৫, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫
বীরপ্রতীক আব্দুল হাই সরকার
কুড়িগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৬ ডিসেম্বর স্মরণীয় দিন। এ দিনে বীর প্রতীক আব্দুল হাই সরকারের নেতৃত্বে ৩৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই করেন। মৃত্যুকে উপেক্ষা করে সংগঠিত এ বাহিনীই সেদিনের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কুড়িগ্রামকে হানাদারমুক্ত করেছিলেন।
১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিবাহিনীর কে-ওয়ান এফএফ কোম্পানি কমান্ডার বীর প্রতীক আব্দুল হাই সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বিকেল ৪টায় কুড়িগ্রাম শহরে প্রথম প্রবেশ করে। এরপর তারা নতুন শহরের ওভার হেড পানির ট্যাংকের ওপরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে চারিদিকে ছড়িয়ে দেন বিজয়বার্তা। সেদিন বিজয় মিছিলে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানাতে হাজারো মুক্তিকামী মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন।
আব্দুল হাই সরকার ছিলেন এক কৌশলী অধিনায়ক। মাত্র ১৬ বছরের টগবগে এ কিশোর পান ৬ নম্বর সেক্টরের অধীন কুড়িগ্রাম-১ এর কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব। সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ভৌগোলিক সুবিধা ব্যবহার করে স্থানীয় যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। সব ক্ষেত্রেই ছিল তার বলিষ্ঠ ভূমিকা। সে সময় সশস্ত্র লড়াইয়ের পাশাপাশি তথ্য সংগ্রহ, শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও দল সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তার ছিল অসাধারণ দক্ষতা।
নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ, কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক– সবাইকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করা হয় ৩৩৫ জনের দল, যা এক সময় পরিণত হয় অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পিত হামলা পাক-বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলে। এভাবে ৬ ডিসেম্বর বিকেলে শেষ দফা আক্রমণে মুক্ত হয় কুড়িগ্রাম শহর।
স্থানীয়রা বলেন, সে দিনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন ছিল স্বাধীনতার আগমনী সুর। গোলাগুলির শব্দ থামার পর শহরের মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, বরণ করে নেন মুক্তিযোদ্ধাদের। কুড়িগ্রাম জেলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিজয়ের উল্লাস।
আব্দুল হাই সরকার পরবর্তীতে তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে পান বীর প্রতীক খেতাব, যা কুড়িগ্রামের মানুষের জন্য গর্বের এক অনন্য পরিচয়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও তার সেই অবদান আজও প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে।
বীর প্রতীক এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কুড়িগ্রাম জেলার মানুষের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। ১৯৭১ সালে এ জেলা ছিল একটি মহকুমা। সে সময় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে ১০ মার্চ মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। ১৭ মার্চ স্থানীয় তরুণ নেতারা চিলড্রেন পার্কে আনুষ্ঠানিকভাবে মানচিত্র আঁকা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।
২৫ মার্চের কাল রাতের পর সংগ্রাম কমিটি ২৮ মার্চ গওহর পার্ক ময়দানে জনসভা করে বেসরকারি হাইকমান্ড গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। ৩০ মার্চ রংপুরের ইপিআর উইং-এর সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন কিছু সঙ্গী নিয়ে কুড়িগ্রামে চলে আসেন। তার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ১ এপ্রিল থেকে তিস্তার পূর্বপাড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ৪ এপ্রিল পাকবাহিনী লালমানিরহাট দখল করে। এরপর পাক বাহিনী ৭ এপ্রিল ও ১৪ এপ্রিল দুবার কুড়িগ্রাম দখলে ব্যর্থ হওয়ার পর ২০ এপ্রিল কুড়িগ্রাম শহর দখল করে।
এরপর থেকে কুড়িগ্রাম মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে জুলাই থেকে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালনা করতে থাকেন একের পর এক সফল অভিযান। ১৩ নভেম্বর উলিপুরের হাতিয়ায় পাকবাহিনী গণহত্যা চালায়। এদিন পাকবাহিনী পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৭৩৪ নিরীহ মানুষকে দাগারকুটি বধ্যভূমিতে জড়ো করে হত্যা করে।
১৪ নভেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে জেলার ভূরুঙ্গামারী, ২৮ নভেম্বর নাগেশ্বরী, ৩০ নভেম্বর সমগ্র উত্তর ধরলা এবং ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম শহরসহ পুরো জেলা হানাদার মুক্ত করে। এদিন দুপুরে পাক সেনারা রেলপথে কুড়িগ্রাম ছাড়ে।
মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক আব্দুল হাই সরকার বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়া যেমন আমাদের গর্ব, তেমনি আমি যুদ্ধ করে জন্মস্থান কুড়িগ্রামকে স্বাধীন করেছি, এটাও আমাদের গর্ব। গোটা দেশ একদিনে স্বাধীন হয়নি, বিভিন্ন দিন বিভিন্ন অঞ্চল হানাদার মুক্ত হয়েছে। এ বীরত্বগুলোর গুরুত্ব আছে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে এসব বীরত্ব জানানো এবং তাদের এ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা আমাদের দায়িত্ব। সেই জায়গাটা তৈরি করতে হবে।’
