‘আর্টিলারি শেলিং’-এ নায়েব সুবেদার আশরাফের পুরো মাথাটাই উড়ে গিয়েছিল
মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
প্রকাশ: ০৩:২৫, ৫ ডিসেম্বর ২০২৫
মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক। গ্রাফিকস: সমাজকাল
যুদ্ধক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ সাফল্য বলতে কিছু নেই। ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়েই সাফল্য আসে। যুদ্ধক্ষেত্রে কেন আমাদের মনোবল বা মনের শক্তি টিকে থাকে, তার কারণ যুদ্ধের মাধ্যমেই আমরা ধৈর্যকে শক্তিশালী করতে পেরেছি। ধৈর্য অর্জন করতে পেরেছি। যুদ্ধ শেষ হয়েছে সে বহু বছর। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের একটি ঘটনা, একটি মানুষকে আজও আমার মনে পড়ে।
মানুষটি নায়েব সুবেদার আশরাফ। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের দুই বা তিন তারিখ। সময় আনুমানিক রাত সাড়ে আটটা-নয়টা হতে পারে।আখাউড়ার রেলস্টেশন থেকে শহরের দিকে মুখ করে আমাদের দুটি কোম্পানি অবস্থান নিয়েছে।
আমি ছিলাম আখাউড়া রেললাইন ও তিতাস নদীর মাঝখানে। আর্টিলারি গোলাবর্ষণ হলো। কিছুক্ষণ পর যখন গোলাবর্ষণ থামল, আমি আমার গর্ত থেকে বের হলাম। যাকে আমরা বলি শিয়ালের গর্ত, সেখান থেকে। অর্থাৎ একটি কলসির মতো গর্ত করা হয় যেন একটি লোক কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করতে পারে। মাথাটি মাটির নিচে থাকে। গর্ত থেকে বেরিয়ে বললাম, আশরাফকে ডাকো।
আমার নিকটতম সৈনিক বলল, ‘নাই’! বললাম, নাই মানে, ডাকো না তাকে। সে আবারও বলল, ‘বলছি তো, নাই’। বললাম, আশরাফ এত রাতে কোথায় গেছে, ডাক দিতে পারছ না কেন? সে তখন জোরে জোরে বলল, ‘আমি বলতেছি নাই, আপনি বলতেছেন ডাকতে পারেন না—কী কথা, স্যার!’
আমি সংবিৎ ফিরে পেলাম, কী হলো তাহলে? সৈনিক তো এ রকম করে কথা বলে না। নায়েব সুবেদার আশরাফের গর্তের কাছে গেলাম। রাতে যুদ্ধক্ষেত্রে যেকোনো প্রকার আগুনের চিহ্ন দেওয়াও বিপজ্জনক। তার শিয়ালের গর্তের ওপর আমার বাম হাতটা রাখলাম। খুঁজতেছি আশরাফকে ডাকার জন্য। যেমন করে একজন মানুষকে মাথায় ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকে। সেখানে আমি মাথা পেলাম না, আমার হাতটা লাগল তার ঠিক কণ্ঠনালির ওপর। কারণ আর্টিলারি শেলিংয়ে তার পুরো মাথাটাই কেটে উড়ে চলে গিয়েছিল। এজন্যই সৈনিক বলছিল, ‘নাই’! নাই মানে দুনিয়াতেই নাই। ওই অবস্থায় তার মানসিক অবস্থা এমনই ছিল যে, পুরো বাক্য সমাপ্তির অবস্থায় ছিল না সেই সৈনিক।
ঘটনাটি আজও আমাকে নাড়িয়ে দেয়। স্মৃতিকাতর করে তোলে। খুব মনে পড়ে, ভীষণ মনে পড়ে নায়েব সুবেদার আশরাফকে।
পরিচিতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক
