রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫

| ২৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতেও এহন ভয় লাগে!

সুবাস চন্দ্র বন্দ, বীর মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশ: ১৪:৩৮, ৩ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২২:২৮, ৩ ডিসেম্বর ২০২৫

মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতেও এহন ভয় লাগে!

বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবাস চন্দ্র বন্দ। ছবি: সমাজকাল

একাত্তর সালের জুনের মাঝামাঝি। যুদ্ধ চলতাছে। সেই সময় ভারতে যাই। বাবা-মাও জানত না। বলে যাই নাই। বললে যাইতে দিতো না। ওখানে আগে থেকেই আমার বোন-টইন থাহে, শরণার্থী ক্যাম্পে। শরণার্থী ক্যাম্পে থাহি। খানাটানা খাই। মাসখানেক পরে, আমার লগে যাওয়া কুমুদ পাল, হেয় কইলো কী, ‘আরে লঙ্গরখানার খানা খাইয়া বাঁচতাম না। আর যেই অবস্থা, দেশ তো সহসা স্বাধীন হইতো (হবে না) না। লঙ্গরখানার খানা খাইয়া মইরা যামগা। যুদ্ধ কইরা মইরাম, হেইডা ভালা। দেশের লাইগা মইরা যামগা। ল, যুদ্ধে যাই। স্বাধীনতার যুদ্ধে। কাউরে কিছু কইতাম না।’

একাত্তরের ১৬-১৭ জুলাই, শরণার্থী ক্যাম্প থেকে সন্ধ্যার দিকে দুজনে পালাটানা ক্যাম্পে (ত্রিপুরার একটি প্রশিক্ষণ শিবির) যাই। ক্যাম্পে কফিল উদ্দীন সরকার ছিলেন আমাদের পরিচিত। কফিল উদ্দীনের বাড়ি মাধাইয়ার কলাগাও (কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার একটি এলাকা)। ওখানে তিনি অফিসের কাজটাজ করতেন। ক্যাম্প পরিচালনায় ছিলেন ক্যাপ্টেন সুজাত আলী। কুমিল্লার দেবিদ্বারের। সন্ধ্যায় ক্যাম্পে গিয়া ভর্তি হইছি। আমারারে ব্যারাকে নিয়া গেলো।

রাত চাইরটায় খানা দিলো। আমরা তহন পেডের খিদায় অস্থির। কিন্তু খানা আর খাইতাম পারি না। যেই রান্ধা! মুক্তিযোদ্ধারাই রান্ধে। ৮ জন মিইল্লা। স্টেপ বাই স্টেপ। সিরিয়াল আসে। ক্যাম্পে ১২শ জনেরও বেশি ছিলাম আমরা। সকাল হইছে। হুইসাল দিছে। মালেক নামে একজন আছিলো। বাড়ি চাঁদপুর। ট্রেইনিং সেন্টারে আঙ্গরে নিত-আনত। বৃষ্টি আইলে আমরা ব্যারাকে ফিরা যাইতাম। এতে তিনি অখুশি হইলেন। একটা বেতন নিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমাদের জন্য ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করি। আর তা তোমরা ভায়োলেট করো।’

মনে মনে কইলাম, ভর্তি হইয়া যহন বিপদে পইড়া গেলাম। আমরা কি কারও ভাত খাই। কী কইরাম। কোনো উপায় নাই। ট্রেনিং করতেই হইব। ৩০ জনে ক্লাস হইতো। শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে হইতো। না করলে বিপদ। কঠিন শাস্তি। ৪৬ দিনে ট্রেইনিং শেষ হইলো। ফিরে আই দেশে। যুদ্ধের মাঠে পাঠাইলো। লাকসাম-চৌদ্দগ্রাম এলাকায় আমাদের যুদ্ধের ডিউটি আছিলো। প্রথম দিন এলাকার মানুষরে জিগাইতাম, তোমাগো কোনো অসুবিধা-টসিবিধা আছেনি। রাজাকারদের খুঁইজা খুঁইজা বাইর করতাম। রাজাকার খুঁইজা বাইর করতে করতে ৮-১০ দিন লাগছিলো। রাজাকাররা যাতে পাকিস্তানি আর্মিরে খবর দিতে না পারে, ওই ভাবে ডিউটি দিতাম। আমরার লগে ইন্ডিয়ান আর্মিও থাকতো। আমরা একলগে ১০০-১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা একটি গ্রামে ঢুকতাম। এক গ্রামে বেশিদিন থাকতাম না।

যুদ্ধের মাঠে বড় রকমের প্রতিরোধের সামনে পড়ি চান্দিনার করতলা। বাড়েরাসংলগ্ন এলাকা। এহানে চাইরদিন যুদ্ধ হইছে। ইন্ডিয়ান আর্মিও আছিলো আমাদের লগে। পাক আর্মিদের আমরা ব্যারিকেড দিয়ে ফেলছিলাম। একদিকে বড়ুরার মুক্তিযোদ্ধারা, অন্য দিকে চান্দিনার মুক্তিযোদ্ধা, আরেক দিক দিয়া দেবিদ্বারের মুক্তিযোদ্ধারা আছিলেন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। ২৩ জন পাইনজাবি মারা গেছিলো। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছিলো ৮ জন। পোলাফাইন, ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা; আমরা স্বাধীন হইছি’ কইয়া দৌড়াইয়া যাইতাছে। ১০ অথবা ১১ ডিসেম্বরের ঘটনা এটা।

একজন পাইনজাবি। ছোড ছোড ধান গাছ। ধানক্ষেতে বইয়া বইয়া পায়ে ব্যান্ডেজ লাগাইতাছিলো। তার পায়ে গুলি লাগছিলো। জয় বাংলা বইলা দৌড়াইতে থাকা একটা পোলা পাইনজাবিরটার উপরে গিয়া লইয়া পড়ছে! এইটুকুন পোলা। পাইনজাবি তারে গালি দিলো, ‘বাইনচোদ কা বাচ্চা...!’ আমি কই, আরে সব্বনাশ। এহানেদি পাইনজাবি। আমরা পাইনজাবিটার দিকে তাক কইরা অস্ত্র ধরছি। আমরা তিনজন এহানো। আমি, কুমুদ ও ছেংগাছিয়ার সিদ্দিক। আমরা কওয়াকয়ী করি, ল, তারে বাইত লইয়া যাই, মহিচাইল। তাগো জ্বালায় কী পরিমাণ কষ্ট পাইছে মানুষ তা দেহাম, আর ব্লেড দিয়া তারে চাইছাম (চাছা-ছাল ছাড়ানো)। এত্তারা মুনী, নেম কেমনে। একশ কেজির হইবো। না, সম্ভব না।

পাইনজাবিটা এহাইয়া কইতাছে, বন্ধু এদারসে মারো (সামনে দিয়া, বুকে মারার কথা বলছে)। মানে সামনে দিয়া মারলে হইবো বীর পুরুষ। সামনাসামনি যুদ্ধ মরলে বীরের মৃত্যু। গাড়িও নাই। রাস্তাও ভালা নাই। বাজারে কেমনে নেম। মহিচাইল বাজারে মানুষ ভরা। আমি কইলাম, নাহ। পারতাম না। অনেক ওজন। তারপর করলাম কী, তার মাথায় গুলি করলাম। গুলিতে পাইনজাবির মাথার খুলিডা উইড়া গেলো। ২৩ জন পাইনজাবি মারছিলাম। মানুষ কইতাছিলো, স্যার লাশগুলা কিতা কইরাম? কইলাম, ৭-৮ জন কইরা গাতা কইরা মাডি দিয়া লা। বেশি গাতা করা লাগদো না। শিয়ালে খাইয়া মোডা অইবো!

রাজাকাররা আছিলো থানাত। চান্দিনা। এক-তারে একটা গাই দিছিলাম বেয়নেট দিয়া, বাম হাতের উপরের অংশে। বুলেট যদি খরচ কইরা লাই, পরে যদি আবার যুদ্ধ লাগে, তখন কিতা কইরাম। তে যহন আমাগো সামনে আছে, বেয়নেট দিয়া গাই দিই। বেয়নেটের আঘাত পানক সাপের মতন বিষাক্ত। হেই সময় রক্ত দেকলে আনন্দ লাগতো! যুদ্ধক্ষেত্র এমন এক জিনিস, ওই খানে যে না গেছে হেয় কইত পারত না। যুদ্ধ যে কতো আনন্দ, যদি লগে বুলেট থাহে! অস্ত্র ঠিক থাকলে মরণের কোনো চিন্তা নাই। ১২ ডিসেম্বর চান্দিনা শক্রমুক্ত হইছিলো।

১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের খবর আইলো। বিকালে। লোক মারফত। মুক্তিযোদ্ধারা ফাঁকা আওয়াজ করলেন। সব মুক্তিযোদ্ধাই আনন্দ মিছিল করছে ফাঁকা আওয়াজ কইরা। হগলে আনন্দ-উৎসব করতাছি। এইজনে হেইজনে কওয়াকয়ী করতাছি, বঙ্গবন্ধু জানি আইয়ে কবে?বঙ্গবন্ধুর ভাষণডা লাগাইলে সবার চোখ দিয়া পানি পড়তো। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কথা নাই। সবাই বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু করতো। গাছের পাতাডিও বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু করছে। কবে আইবো দেশ, কবে আইবো দেশ। আমরা প্রথম হুনছিলাম, বঙ্গবন্ধুরে মাইরা লাইছে। পরে হুনলাম, পাকিস্তান থেইক্কা লন্ডনে গেছেন।

গ্রামে গেলাম। রাজাকারদের অনেকেই তহন টাকা লইয়া আইয়ে। কয়, স্যার; ধরেন! কইতাম, ভালো অইয়া যাও। আমারে যেই টেহাডি দিবা, এডি দিয়া পোলাফাইনডি নিয়া ভালা থাহ। ১৬ ডিসেম্বরের পরে রাজাকারদের সহালে একবার পিটতাম, বিকালে একবার পিটতাম। ড্রপ তার দিয়া পিডা দিতাম। রক্তে ভাইসা যাইত!

দুঃখ তো আছেই। যে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে গেলাম, যে বত্রিশ নম্বর বাড়ি থেইক্কা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার কথা কইতেন, প্লান-প্রোগ্রাম করতেন, হেই বাড়িডা ধ্বংস কইরো দিলো। এর চেয়ে আর দুঃখ নাই, এর চেয়ে মইরা যাওন ভালা। একটা ঐতিহাসিক স্থান শেষ কইরা দিলো। শেষ কইরা দিছে, এহনদো আমরার করার কিছু নাই। এহনদো আমরা অসহায়। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে কারও কাছে পরিচয় দিতেও এহন ভয় লাগে! কোন সময় ধইরা নিয়া অত্যাচার কইরানি মাইরা লায়। এমন বাংলাদেশ তো চায় নাই মুক্তিযোদ্ধারা। 

পরিচিতি: সুবাস চন্দ্র বন্দ, সনদপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। মহিচাইল বাড়ীপাড়া, চান্দিনা, কুমিল্লা

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ:

আজ নোয়াখালী মুক্ত দিবস
শিক্ষা ভবনের সামনে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
শেখ হাসিনাসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু
বিটিআরসির সামনে মোবাইল ব্যবসায়ীদের সড়ক অবরোধ
‘মিনেসোটা প্রোটোকল’ মেনে শুরু জুলাই শহীদদের শনাক্তকরণ
বইয়ের জ্ঞান খেলাপিদের কাছে হার মানল: উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন
এভারকেয়ারে জোবাইদা, চলছে মেডিকেল বোর্ডের সভা
স্কুলিং মডেল বাতিলের দাবিতে শাহবাগ অবরোধ শিক্ষার্থীদের
বাংলাদেশের সঙ্গে স্থিতিশীল সম্পর্ক চায় ভারত: প্রণয় ভার্মা
নির্বাচনে ৮৯% সাংবাদিক নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কায়: জরিপ
১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মেডিকেল কোচিং সেন্টার বন্ধ
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ : বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ভারত ও ভুটান
জুলাই আন্দোলনের অজ্ঞাত ১১৪ শহীদের পরিচয় শনাক্তে সিআইডির উদ্যোগ
জানুয়ারির শুরুতেই শিক্ষার্থীরা বই পাবে: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা
সেন্টমার্টিন থেকে ১৮৫০ কেজি বর্জ্য অপসারণ করল কেওক্রাডং
বিএনপি ‘প্রতিশ্রুতির রাজনীতিতে’ বিশ্বাসী: রিজভী
খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নিতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত
সিএমপির সব থানার ওসি রদবদল
যে কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করতে পেরেছি
৬৪ জেলায় ৬৪ বন্যপ্রাণী কর্মীকে স্বীকৃতি দেবে সরকার