জমজ দুই শিশুর দুই পিতা

লন্ডনে এক সমকামী দম্পতি একজোড়া জমজ শিশুর পিতা  হয়েছেন। বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, একই নারীর গর্ভে ওই সমকামী দুই পুরুষের শুক্রাণু নিষিক্ত করা হয়েছিলো। খুব সাফল্যজনকভাবে সারোগেট মা এক জোড়া জমজ ছেলে ও মেয়ে শিশুর জন্ম দেন। ফলে ওই দম্পতি আলাদাভাবে পিতা হয়েছেন। 

ডেইলি মেইল জানায়, জমজ শিশুদের মধ্যে ক্যাল্ডার ছেলে এবং আলেকজান্দ্রা বার্নি এডওয়ার্ডস মেয়ে। তবে একই সময়ে জন্মগ্রহণ করলেও তারা আসলে সৎ ভাইবোন। কারণ এক মায়ের পেটে জন্ম হলেও তাদের পিতা আলাদা। 

লন্ডনের ওই দম্পতি সাইমন এবং গ্রেইম আলাদাভাবে পিতা হতে চেয়েছিলেন। তাই তারা সারোগেট মা ৩২ বছর বয়সী মেগ স্টোনের সঙ্গে কানাডায় গিয়ে দেখা করেন। কারণ যুক্তরাজ্যে এখনও দুইজন ভিন্ন পুরুষের শুক্রাণু একসঙ্গে একই মায়ের গর্ভে স্থাপন করা হয় না। এটা আইন বিরোধী। 

আইভিএফ-এ আশ্চর্যজনক অগ্রগতির ফলে দম্পতি একটি করে ভ্রূণ নিষিক্ত করতে সক্ষম হন এবং উভয়কেই সারোগেট মা মেগ স্টোনের গর্ভে স্থাপন করা হয়।

৪৩ বছর বয়সী সাইমন বলেন, মেগ একটি আশ্চর্যজনক কাজ করেছে। সে একই সময়ে আমাদের দুজনের দ্বারা গর্ভবতী হয়েছিলো। আমরা তার মাধ্যমে আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি।

গ্রেইম ও আমি সবসময় একটি পরিবার চাইতাম এবং এখন আমাদের সুন্দর জমজ সন্তান আছে।

ছবি: সংগৃহীত

দম্পতি জানতেন যে তারা এইভাবে একটি পরিবার শুরু করার চেষ্টা করতে চান। কারণ জন্ম শংসাপত্রে তারা তাদের পিতামাতা হবেন।

সাইমন জানান, আমরা দীর্ঘদিন ধরে একজন সারোগেট মায়ের সন্ধান করছিলাম। তখন কানাডার নাগরিক মেগ আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। মেগের আগে থেকেই পরিবার ছিলো। তার দুই ছেলের মধ্যে জেফ্রির বয়স ১২ এবং ম্যাক্সের পাঁচ বছর।

মেগ বলেন, আমি একটি সারোগেসি ওয়েবসাইটে সাইমন ও গ্রেইমের প্রোফাইল দেখেছিলাম। সম্প্রতি আমার সঙ্গীর সাথে বিচ্ছেদ হয়েছে। অন্য সন্তানের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তাই আমি কাউকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিলো সন্তান পেলে তাদের মুখে সুন্দর হাসি ফুটবে।

এই দম্পতি বলেছেন, মেগের সাথে দেখা করা ছিলো দীর্ঘদিন ধরে হারিয়ে যাওয়া বোনের সাথে পুনর্মিলনের মতো। আমরা একজন অজ্ঞাত ডিম্বাণু দাতাকে খুঁজছিলাম। তারপর ভ্রূণগুলিকে নিষিক্ত করার জন্য মেগকে নিয়ে ২০১৮ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি ফার্টিলিটি ক্লিনিকে যাই। 

সাইমন বলেছিলেন, আমরা প্রথমে সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি, জৈবিক পিতা কে হবেন। গ্রেইম বলেছিলো, এটি আমার হওয়া উচিত, কিন্তু আমি বলেছিলাম, তারও আমার মতোই অধিকার রয়েছে।

আমরা যখন ক্লিনিকের ডাক্তারের সাথে কথা বলছিলাম, তখন তিনি আমাদের অবাক করে দিয়েছিলেন। তিনি আমাদের বলেছিলেন, এটি আমাদের দুজনেরই হতে পারে।

তারা বলেছিলেন, অর্ধেক ভ্রূণ আমার শুক্রাণু দিয়ে এবং অর্ধেক গ্রামের শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত করা যেতে পারে।

এরপর দম্পতি বিয়ে করেন এবং হানিমুনে কানাডায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একই সাথে প্রথমবারের মতো মেগের সাথে দেখা করেন।

এই দম্পতি এখন মেগকে তাদের জমজ সন্তানের 'টামি মামি' বলে সম্বোধন করেন, যাকে তিনি ভালোবাসেন বলে জানান। 

এই দম্পতি বলেন, তাদের দুই সন্তান শক্তি থেকে শক্তিতে পরিণত হয়েছে এবং তাদের সকল মাইলফলক স্পর্শ করছে। আমরা বুঝতে পারিনি কিভাবে তাকে ধন্যবাদ জানাবো। আমরা তাকে বলেছিলাম, আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। সে কেবল আমাদের জীবনই নয়, আমাদের পরিবারকেও বদলে দিয়েছে। 

ছবি: সংগৃহীত

ছয় মাস পরে সাইমনের একটি নিষিক্ত ভ্রূণ এবং গ্রেমের একটি ভ্রূণ মেগের গর্ভে স্থাপন করা হয়েছিলো।

তারপর কী হবে এবং এটি কাজ করবে কি-না তা দেখার জন্য তাদের দুই সপ্তাহের যন্ত্রণাদায়ক অপেক্ষার মুখোমুখি হতে হয়।

এই দম্পতি মাত্র একটি ভ্রূণ স্থাপন করতে চেয়েছিলেন, যার অর্থ তাদের মধ্যে কেবল একজনই শিশুর জৈবিক পিতা হবেন। 

সাইমন বলেন, আমরা এটা নিয়ে কথা বলেছি এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যদি এটি ঘটে, তাহলে আমরা ফিরে যাব। আবার চেষ্টা করবো, যাতে আমরা প্রতিটি শিশুর আলাদাভাবে বাবা হতে পারি।

আইভিএফ পদ্ধতিতে শুক্রাণু নিষিক্ত করার আগে ডিম্বাশয়কে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ডিম্বাণু উৎপাদনে উৎসাহিত করতে প্রথমে ওষুধ দিয়ে মাসিক চক্র বন্ধ করা হয়।

ডিম্বাণুর বিকাশ পরীক্ষার জন্য করা হয় একটি আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান। তাদের পরিপক্ক হতে প্রয়োগ করা হয় ওষুধ।

তারপর শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত করার আগে সারোগেটিভ মায়ের বিশেষ অঙ্গে ডিম্বাণু প্রবেশ করার পর তা একটি সুই দ্বারা সংগ্রহ করা হয়।

অবশেষে নিষিক্ত ভ্রূণকে বৃদ্ধি এবং বিকাশের জন্য গর্ভে স্থানান্তর করা হয়।

৩৫ বছরের কম বয়সীদের আইভিএফের গড় সাফল্যের হার ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ। ৪৩ ও ৪৪ বছর বয়সী মহিলাদের ক্ষেত্রে পাঁচ শতাংশ এবং ৪৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে ১ দশমিক নয় শতাংশ।

কিন্তু ৩৫ বছরের কম বয়সীদের আইভিএফ সবচেয়ে কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও ৫৭ শতাংশ আইভিএফ ৩৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মহিলাদের করা হয়। 

দুই সপ্তাহ শেষ হওয়ার পর মেগ দুর্দান্ত খবর পেয়েছিলেন, তিনি গর্ভবতী ছিলেন। অপেক্ষা করতে হয়েছিলো সে উভয় সন্তানের গর্ভবতী ছিলেন, নাকি শুধু একটি।

কয়েক সপ্তাহ পর মেগের স্ক্যান করা হয়েছিলো। উভয় ভ্রূণই গর্ভাশয় গ্রহণ করেছিলো। অর্থাৎ মেগ উভয় পিতার শিশুসন্তানের সাথে গর্ভবতী ছিলেন।

সাইমন বলেছিলেন, স্ক্যানিং রুমে প্রথমে আমরা একটি হৃদস্পন্দন দেখতে পেলাম। তারপর দেখতে পেলাম অন্য হৃদস্পন্দন। তখন গ্রেম ও আমি একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম। আমরা খুব আনন্দিত ছিলাম। আমরা দুজনেই বাবা হতে চলেছিলাম। 

আমরা নিয়মিত মেগের সাথে যোগাযোগ রাখতাম এবং সে আমাদের গর্ভাবস্থা কেমন চলছে সে সম্পর্কে আপডেট দিতো। 

আমরা কানাডায় তার ১৯ সপ্তাহের স্ক্যান দেখতে গিয়েছিলাম। তার কোমরে হাত রেখেছিলাম। এবং আমাদের বাচ্চাদের লাথি মারা অনুভব করেছিলাম। এটি একটি জাদুকরী মুহূর্ত ছিলো।

ক্রিসমাসে সে আমাদের সাথে সুন্দর ফটোশুটের ব্যবস্থা করেছিলো। তার পরিবারের সাথেও আমরা দেখা করেছিলাম, যা ছিলো দুর্দান্ত। তাকে তার সন্তানদের মা হতে দেখে খুব ভালো লেগেছে। আমরা জানতাম যে আমাদের বাচ্চারা সেরা হাতে রয়েছে।

ছবি: সংগৃহীত

প্রসব সুষ্ঠুভাবে শেষ হয়েছিলো। কিন্তু ৩১ সপ্তাহের গর্ভবতী মেগ মেসেজে জানিয়েছিলো, তার ব্যথা হচ্ছে এবং তিনি ভেবেছিলেন এটা তার প্রসববেদনা। কিন্তু সেটা ফলস ছিলো। দুই সন্তান পাঁচ সপ্তাহ আগেই জন্ম নিয়েছিলো। ভেবেছিলাম, আমরা প্রসবের সময় পৌঁছাতে পারবো কি-না।

জিনিসপত্র গুছিয়ে আমরা কানাডার প্রথম ফ্লাইট ধরলাম। কিন্তু আমরা যখন আকাশে ছিলাম, তখন মেগের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারিনি কী হচ্ছে। আমাদের অপেক্ষা করা খুব যন্ত্রণাদায়ক ছিলো।

৩৬ সপ্তাহে মেগের প্রসববেদনা শুরু হয়। গ্রেইম তার হাত ধরে রেখেছিলো। তার মা এবং আমি অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

এটি ছিলো জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক অভিজ্ঞতা। প্রথমে আলেকজান্দ্রার জন্ম হয়েছিলো এবং তার কয়েক মিনিট পর ক্যাল্ডার এসেছিলো। তারা উভয়ই সুস্থ ছিলো এবং অবশেষে তাদের সাথে দেখা করা সত্যিই আশ্চর্যজনক ছিলো।

যখন আমরা দুজনেই প্রথমবার তাদের কোলে নিয়েছিলাম, তখন বিশ্বাস করতে পারিনি যে আমরা দুজনেই বাবা। এটা করতে অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছিলো, কিন্তু দুজনেই একজন করে যমজ সন্তানের বাবা হতে পেরেছি।

ক্যালডার ছিলেন গ্রেইমের যমজ সন্তান, আর আলেকজান্দ্রা ছিলেন আমার প্রতিচ্ছবি।

অবশেষে সাত সপ্তাহ পর আমাদের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো। মেগকে বিদায় জানানো দুঃখজনক ছিলো। যখন আমরা প্রথম তার বাড়িতে এসেছিলাম, তখন এটি অবিশ্বাস্য ছিলো। 

আমরা TAMBA, যুক্তরাজ্যের যমজ এবং একাধিক জন্মদানকারী সংস্থার কাছ থেকেও দুর্দান্ত সমর্থন পেয়েছি, যা ছিলো অসাধারণ।

সাইমন আরও বলেন, দুটি বাচ্চা একসঙ্গে জন্মানো কঠিন কাজ, কিন্তু গ্রেইম এবং আমি প্রতিটি মুহূর্ত দারুন উপভোগ করেছি।

আমরা এখনও নিয়মিত মেগের সাথে যোগাযোগ রাখি এবং সে আমাদের জন্য যা করেছে তার জন্য আমরা তাকে যথেষ্ট ধন্যবাদ জানাতে পারি না। এটা ভাবতে অবাক লাগে যে সে আমাদের দুজনকে বাবা হতে সাহায্য  করেছে। এটি একটি দুর্দান্ত উপহার।

মেগ বলেন, সাইমন এবং গ্রেইম এখন আমার কাছে ভাইয়ের মতো। তারা আমাকে যমজদের 'টামি মামি' বলে ডাকে যা আমি ভালোবাসি।

তাদের উভয়েরই ভ্রূণ দিয়ে গর্ভবতী হওয়া আশ্চর্যজনক ছিলো। বিজ্ঞান একটি আশ্চর্যজনক জিনিস, বলেন মেগ।