ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২: রুমিন মনোনয়ন না পেলে এগিয়ে থাকবে জামায়াত?
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৪:৩৭, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১৫:৫৯, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫
মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, রুমিন ফারহানা ও জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা মোবারক হোসাইন আকন্দ। ফাইল ছবি
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সামনে আসছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের (সরাইল-আশুগঞ্জ-বিজয়নগরের একাংশ) নানা সমীকরণও। শেষ পর্যন্ত কে হচ্ছেন বিএনপি জোটের প্রার্থী বা জয়ের পথে এগিয়ে থাকছেন কে- এ আলোচনা এখন সর্বত্র।
তবে টকশো’ তারকা বা মেধাবী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বিএনপি জোটের মনোনয়ন না পেলে জামায়াতের প্রার্থী এগিয়ে থাকবেন কি না, এটাই বেশি আলোচ্য বিষয়। জোটের প্রার্থী উপযুক্ত না হলে বা জোট ঐক্যবদ্ধ না থাকলে জামায়াত জোটের প্রার্থী এগিয়ে থাকবে প্রায় নিশ্চিত বলেই মনে করছেন এলাকার মানুষ।
এ আসনে জামায়াতের মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আমির মাওলানা মোবারক হোসাইন আকন্দ। ১ জুন জেলার ছয় আসনে জামায়াতের মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই মাঠে তৎপর মোবারক হোসাইন আকন্দ ও দলের নেতাকর্মীরা।
অন্যদিকে এখন পর্যন্ত এ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। দলটির ছাড়ে এখানে অন্য দলের কেউ প্রার্থী হচ্ছেন, এখন পর্যন্ত স্থির এমনটাই। বিশেষ করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহ সভাপতি ও জনপ্রিয় ইসলামি বক্তা মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব প্রার্থী হতে পারেন বলে আলোচনা আছে। তিনি নিজেও বিভিন্ন সময় এমন ঈঙ্গিত দিয়েছেন। তবে বিএনপির মনোনয়ন না পাওয়া দলের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন বলেও আলোচনা রয়েছে।
বিএনপির কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে মাঠে লড়াইয়ের হিসেব হবে এক ধরনের। যদি তা না হয় তাহলে চিত্র হবে আরেক রকম। এসব হিসেব-নিকেশেই এখন পর্যন্ত জামায়াতের প্রার্থীকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
সরাইল, আশুগঞ্জ ও বিজয়নগরে খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে আসা যাওয়া ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ শুরু করেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। চমৎকার বক্তব্য, সদা হাসিমুখ ও আন্তরিক আচরণ দিয়ে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের পছন্দের তালিকায় চলে আসেন। তাছাড়া তার বাবা ভাষাসৈনিক ও বরেণ্য রাজনীতিবিদ অলি আহাদ এ আসনে রাজনীতি ও নির্বাচন করায় পৈত্রিক পরিচিতিও তাকে অনেকটা সুবিধা দেয়।
রুমিন ফারহানার পৈত্রিক নিবাস বিজয়নগর এবারের নির্বাচনে সদর আসনে পড়ায় তিনি চেষ্টা তদবির করে বিজয়নগর উপজেলার দুটি ইউনিয়নকে সরাইল ও আশুগঞ্জের সাথে যুক্ত করেন। যা তাকে বহিরাগত অপবাদ থেকে রক্ষা করবে। বিগত সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠ এবং নানা বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে রুমিন ফারহানা নিয়মিত এলাকায় জনসংযোগ, সভা-সমাবেশ চালিয়ে যাওয়ায় বিএনপি ও সমমনা দলের নেতাকর্মীরা তাকে ঘিরে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।
রুমিন ছাড়াও আরো আটজন মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকলেও তিনিই মনোনয়ন পাবেন, এটি মনে করতেন তার কর্মী-সমর্থকসহ নানা শ্রেণির মানুষ। কিন্তু বিএনপির ঘোষিত প্রার্থী তালিকায় রুমিন ফারহানার নাম না থাকায় চরম হতাশ হয়ে পড়েন তারা।
তবে, মনোনয়ন না পেলেও এলাকায় কার্যক্রম অব্যাহত রাখছেন রুমিন ফারহানা। তিনি বলেন, ‘আমি গত ১০ বছর ধরে দলীয় কার্যক্রমসহ সামাজিক নানা কর্মসূচিতে নিয়মিত যোগ দিয়ে যাচ্ছি। নির্বাচনী এলাকার প্রায় সব এলাকায় সভা-সমাবেশ, উঠান বৈঠক করেছি। নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের বিপদে-আপদে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। তারা আমাকে চমৎকারভাবে আপন করে নিয়েছেন। মনোনয়ন এখনো ঘোষণা না হলেও আমি নিয়মিত ওখানে যাচ্ছি। আমৃত্যু তাদের পাশে থাকবো’।
ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা বিগত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসা শেখ মো. শামীম, তরুণ দে, আহসান উদ্দিন খান শিপনসহ কয়েকজন বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী দীর্ঘদিন ধরেই এলাকা চষে বেরিয়েছেন। বিভিন্ন সময় বড়ো বড়ো শোডাউন-সমাবেশ করেছেন। তারাও মনোনয়ন পেতে চেষ্টা তদবির চালিয়ে গেছেন। তবে বিএনপির কারো নামই ঘোষণা না হওয়ায় সকল স্তরের বিএনপি নেতাকর্মীরা নীরবে ক্ষুব্ধ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া -২ আসনে ২০০১ সালে বিএনপি জোটের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন ইসলামি ঐক্যজোটের সভাপতি মুফতি ফজলুল হক আমিনী। তারপর থেকে ইসলামি ঐক্যজোট, হেফাজত ও অন্য ইসলামি দলের নেতাদের আসনটি নির্বাচনী পছন্দের তালিকায়। এ আসনে দীর্ঘদিন ধরেই নির্বাচন করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে আসছেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহ সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামেও তিনি এ আসনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৮৮ ও ২০০১ সালের মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিপুল অনুসারীও তৈরি করতে সক্ষম হন। এ আসনে বেশ কিছু কওমি মাদ্রাসা থাকায় হেফাজতের নেতারা এলাকাটি তাদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবেও মনে করেন।
তবে, ওয়াজ মাহফিলে মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব অংশগ্রহণ করলেও প্রত্যেক এলাকায় জমিয়তের সাংগঠনিক কমিটির কার্যক্রম চোখে না পড়ায় বিএনপির ওপরই তাকে ভরসা করতে হবে বলে মনে করেন রাজনীতি সচেতন মানুষেরা। কিন্তু হেফাজতের অনুসারীরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হওয়ায় মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব কিছুটা বেকায়দায় বলেই মনে করছেন অনেকে। এখানে সক্রিয় প্রচারণা চালাচ্ছেন চরমোনাই পীরের ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ ও খেলাফত মজলিস। এছাড়া মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বাসিন্দা হওয়ায় এটিও তাকে বিব্রত করবে বলেও ধারণা।
মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব বলেন, ‘আমি ১৯৮১ সাল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ নির্বাচনী এলাকায় সক্রিয়। মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ১৯৮৮ ও ২০০১ নির্বাচনে অন্যতম প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করে মাঠ-ঘাট চষে বেরিয়েছি। তখন আমার গ্রামের বাড়ি অষ্টগ্রাম এ নির্বাচনী এলাকায় যুক্ত ছিলো। এখন না থাকলেও নির্বাচনে প্রভাব পড়বে না।
সরাইল উপজেলায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সংগঠন ও কমিটি মাঠ পর্যায়ে থাকলেও আশুগঞ্জ উপজেলায় আছে কি না তিনি নিশ্চিত বলতে পারেন নি। বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি নিয়মিত তাদের সাথে যোগাযোগ রাখি,তারাও যোগাযোগ রাখেন। মনোনয়ন আমিই পাবো এবং সবাই আমার পাশেই থাকবেন’।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনী এলাকার সরাইলের তিনজন ‘শহীদ জুলাই যোদ্ধার’ পরিবারকে দুই লাখ করে মোট ছয় লাখ টাকা দিয়েছে জামায়াত। প্রতিটি গ্রাম পাড়া মহল্লায় গণসংযোগ ছাড়াও আসনটির দুই উপজেলায় পাঁচটি মেডিকেল ক্যাম্পও করেছে দলটি। প্রতিবন্ধিদের মাঝে বিতরণ করেছে হুইল চেয়ার। বেকারত্ব দূরীকরণে অটোরিকশা বিতরণ কার্যক্রমও শুরু করেছে তারা।
এছাড়া এলাকা হিসেবেও জামায়াতের প্রার্থী মোবারক হোসেনের অবস্থান ভালো। তিনি আশুগঞ্জের আন্দিদিল গ্রামের বাসিন্দা। এ উপজেলায় বিএনপির একজন মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকলেও দল থেকে মনোনয়ন না হওয়ায় আপাতত মোবারক হোসেন ছাড়া আশুগঞ্জ উপজেলা থেকে আর কোনো প্রার্থী নেই। এখান থেকে বিএনপির কেউ প্রার্থী না হলে মোবারক হোসেন ছাড়া উপজেলার আর কোনো প্রার্থী থাকবেন না। সেই হিসেবে এলাকার মানুষ হিসেবে তিনি কিছু সুবিধা পাবেন বলেও মনে করেন তার সমর্থকরা।
ওদিকে সরাইল উপজেলায়ও আওয়াজ আছে জামায়াত প্রার্থীর। এই আসনের প্রত্যেকটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা ৫-৬ মাস আগে থেকেই ভোটের জন্য মানুষের কাছে যাচ্ছেন। প্রার্থী নিজে উপস্থিত থেকে গ্রামে পাড়া মহল্লায় নিয়মিত সভা সেমিনার ও উঠান বৈঠক করছেন।
সরাইল ও আশুগঞ্জ এলাকার মানুষ ২০০১ সালে বিএনপি জোটের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। বিগত আওয়ামী লীগের আমলে আওয়ামী লীগের জোটের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। বছরের পর বছর জোটের প্রার্থীকে ভোট দিতে দিতে এলাকার মানুষ ক্লান্ত। তারা তাই দলীয় প্রতীকের প্রার্থীকে ভোট দিতে আগ্রহী। বিএনপির নেতাকর্মীদের বক্তব্য, তারা আর ধানের শীষের বাইরে ভোট দিতে আগ্রহী নয়। তাদের এ মানসিকতা না বদলালে জামায়াত সুবিধা পাবে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
শাহবাজপুর এলাকার বিএনপি নেতা জুনায়েদ খান বলেন, ‘এই আসনে বিএনপি তাদের জোটের প্রার্থী দিলে নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়বেন। এখানে জামায়াতকে মোকাবিলা করতে হলে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাকেই মনোনয়ন দিতে হবে। তিনিই পারবেন এখানে ধানের শীষকে বিজয়ী করতে ।
সরাইল উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরুজ্জামান লস্কর তপু বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ বিএনপি ও ধানের শীষের ঘাঁটি। এখানে বিএনপির কেউ প্রার্থী হলে পরিশ্রম কম হবে। আর জোটের কেউ প্রার্থী হলে পরিশ্রম বেশি হবে। তবে জামায়াত এগিয়ে থাকার প্রশ্নই উঠেনা। আমরা ধানের শীষ প্রতীকের দলীয় প্রার্থী চাই’।
উপজেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক মো. জাবেদ উদ্দন বলেন, ‘আমরা প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার আগেই মানুষের সেবা করার চেষ্টা করছি। এই আসনে আমাদের দলীয় প্রার্থী এমপি হতে পারলে সকল ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করব’।
জামায়াতের প্রার্থী মোবারক হোসাইন আকন্দ জানান, নির্বাচনী এলাকার প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রামে তার গণসংযোগ ও উঠান বৈঠক শেষ হয়েছে। বিএনপির আমলে মন্ত্রী -এমপি থাকলেও তারা এলাকায় কাঙ্খিত উন্নয়ন করতে পারেননি। তাছাড়া আওয়ামী লীগের দুঃশাসনে এ বছর আমাদের ব্যাপক সাংগঠনিক ও সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে এলাকায় দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের পক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে’।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে ১৯টি ইউনিয়নের মোট ভোটার চার লাখ ৯২ হাজার ৭৯৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ দুই লাখ ৬১ হাজার ৩৯ জন, নারী দুই লাখ ৩১ হাজার ৭৫৬ জন ও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার দুজন। সরাইল উপজেলায় নয়টি ইউনিয়নে মোট ভোটার দুই লাখ ৮৫ হাজার ১৭৬ জন। আশুগঞ্জ উপজেলায় আটটি ইউনিয়নে মোট ভোটার এক লাখ ৫০ হাজার ৬৯৪ জন। সর্বশেষ সীমানা নির্ধারণে সংযুক্ত বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরা ও বুধন্তী ইউনিয়নের মোট ভোটার সংখ্যা ৫৬ হাজার ৯২৭ জন।
